২১ জুলাই ২০২৫ - ০৪:১৭
ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ ফুটবলে একটি স্পর্শকাতর শব্দ হয় হয়ে উঠেছে

ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশকারী ফিলিস্তিনের সমর্থকদের উপর নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আরোপ করতে পারে বিশ্ব ফুটবল সংস্থা ফিফা ও ফুটবল ক্লাবগুলো।

আহলে বাইত (আ.) বার্তা সংস্থা (আবনা):পার্সটুডে সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে: বিশিষ্ট সাংবাদিক ও ক্রীড়া বিশেষজ্ঞ লায়লা হামিদ নতুন আরব বা নিউএরাব নামের একটি ওয়েবসাইটে লিখেছেন, ফুটবল কর্মকর্তারা ফিলিস্তিনকে যতই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন ফুটবলে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গ ততোই জোরদার হচ্ছে এবং ততই ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থন বাড়ছে। 


  ফুটবল বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় ও উন্নত একটি খেলা। ব্রাজিলের দরিদ্র পল্লীগুলোর কিংবা প্যারিসের শহরতলীর শিশুরা তাদের প্রচেষ্টা ও প্রতিভার মাধ্যমে কেবল নিজের ও পরিবারের জীবন বদলে দিচ্ছে তা নয় সমাজেও পরিবর্তন আনছে। অন্য যে কোন খেলার চেয়ে ফুটবলের সঙ্গে জনগণের ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি।  ফুটবল সমাজের নানা শ্রেণীর সীমানা উঠিয়ে দিচ্ছে এবং তুলে ধরছে গোটা সমাজের ছবি। এটি কখনো আয়না কখনো পরিবর্তনের নিয়ামক। ফুটবলের মাঠ কখনো হয়ে ওঠে রাজনীতির অঙ্গন। এই বাস্তবতা তখনও খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন ফিলিস্তিন প্রসঙ্গটি সামনে আসে। যেসব ক্লাব সাম্য ও ন্যায়বিচারের স্লোগান দেয় সেই ক্লাবগুলোই খুব দ্রুত সেইসব কণ্ঠকে নীরব করতে চায় যে কন্ঠগুলো গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনিদের সমর্থন জানায়।  

বড় বড় ক্লাবগুলোর নীরবতা

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বড় বড় ক্লাবগুলো হয় ফিলিস্তিনের প্রতি সমর্থনের প্রতীকগুলোকে আটকে দিয়েছে কিংবা গাজায় ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলী গণহত্যার ব্যাপারে জনগণের সোচ্চার প্রতিবাদের মুখে নীরব থেকেছে।

কয়েক সপ্তাহ আগে, গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি, টটেনহ্যাম হটস্পার ক্লাব নিঃশব্দে তার কয়েক ডজন ভক্তের অ্যাকাউন্ট ব্লক করে, ঘৃণা বা অপমান ছড়ানোর জন্য নয়, টটেনহ্যামের ইসরায়েলি খেলোয়াড় ম্যানর সলোমনের ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতি স্পষ্ট সমর্থনের সমালোচনা করার জন্য।  এরা ছিল ক্লাবের অনুগত ভক্ত যারা বহু বছর ধরে ক্লাবের সাথে ছিল, কিন্তু তারা মাজলুমকে সমর্থন করার সাথে সাথেই  তাদের ত্যাগ করা হয়েছিল। টটেনহ্যাম পরে মিডিয়াকে বলেছিল যে ব্লকগুলি "পশ্চিম এশিয়ার সংঘাত" সম্পর্কিত পোস্টের প্রতিক্রিয়া হিসাবে ছিল। যদিও ক্লাবটি পরে ক্ষমা চেয়েছিল, তবে এটি আরও একটি সতর্কতার মতো ছিল যার অর্থ হল: ফিলিস্তিনকে সমর্থন করার পরিণতি রয়েছে।

যখন টটেনহ্যাম সমর্থকদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখন সলোমন ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য সমর্থনের বার্তা শেয়ার করতে থাকেন যে সেনাবাহিনী যুদ্ধাপরাধ করে, হাসপাতাল ধ্বংস করে এবং প্রতিদিন দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে - কিন্তু ক্লাবটি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি, তদন্ত করেনি এবং শাস্তি দেয়নি।

টটেনহ্যাম উত্তর লন্ডনের একমাত্র ক্লাব নয় যারা ফিলিস্তিনের জন্য জনসমর্থনকে বাধা দেয়। আর্সেনাল, একটি প্রগতিশীল ইতিহাসের অধিকারী এবং সংখ্যালঘুদের জন্য শক্তিশালী সমর্থনের অভিজ্ঞতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও  তাদের ৬১ বছর বয়সী কর্মকর্তা মার্ক বুনিককে বরখাস্ত করেছে যখন তিনি গাজায় ইসরায়েলের পদক্ষেপকে "জাতিগত নির্মূল" বলে অভিহিত করেন। মার্ক ২০ বছরের সেবা সত্ত্বেও অন্যায্য বরখাস্তের জন্য আর্সেনালের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন।

অন্যদিকে, আর্সেনালের খেলোয়াড় "আলেকজান্ডার জিনচেনকো" গাজায় তীব্র বোমা হামলার সময় ইসরায়েলের সমর্থনে একটি বার্তা প্রকাশ করেছেন। পরে তিনি পোস্টটি মুছে দেন এবং তার অ্যাকাউন্টটি ব্যক্তিগত করে দেন, তবুও ক্লাব কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। অন্যদিকে ইসরায়েলের সমালোচনা করে আর্সেনালের মুসলিম সমর্থক গোষ্ঠীর সহ-প্রতিষ্ঠাতার একজনের পুরানো টুইট ভাইরাল হলে, এ নিয়ে তদন্ত করা হয়েছিল।

ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা মানে চাকরি হারানো

ব্রিটেনে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা বিপজ্জনক; কিন্তু তাদের বোমা মেরেছে এমন সরকারকে সমর্থন করা বিপজ্জনক নয়। এটিকে একটি অপরাধমূলক হুমকি হিসাবে বিবেচনা করা হতে পারে এবং এমনকি আপনার চাকরিও চলে যেতে পারে, যেমনটি জাতীয় কিংবদন্তি গ্যারি লিনেকারের ক্ষেত্রে ঘটেছে।

এই মাসের শুরুর দিকে বিবিসি গাজার সম্ভাব্য ইস্যু স্থান পাওয়ার ভয়ে ‘ম্যাচ অফ দ্য ডে’ নামক অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ সালাহর সাথে লিনেকারের চূড়ান্ত সাক্ষাৎকার বাতিল করেছে বলে জানা গেছে।এর্ কিছুক্ষণ পরে, লিনেকার "সোশ্যাল মিডিয়া নীতি লঙ্ঘন" এবং ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য বিবিসি ত্যাগ করেন।

ফিলিস্তিনি ফুটবল ফেডারেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ৩৭৫ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি ফুটবল খেলোয়াড় শহীদ হয়েছেন। মোট শহীদ অ্যাথলেটের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে। সমস্ত স্টেডিয়াম বোমাবর্ষণ করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে গেছে তাদের স্বপ্নসহ যুব ও জাতীয় দল।

আহতদের মধ্যে একজন তরুণ ফুটবল অনুরাগী এবং লিভারপুল সমর্থক রয়েছেন যিনি তার আশেপাশে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর তার উভয় পা হারিয়েছিলেন। তিনি একবার মোহাম্মদ সালাহর পদাঙ্ক অনুসরণ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, কিন্তু এখন তার ভবিষ্যত পঙ্গুত্বের মুখোমুখি।

ফিফা কোনো শ্রদ্ধা জানায়নি, কোনো প্রচার অভিযান শুরু করেনি এবং এক মিনিট নীরবতাও পালন করেনি। কোন বাহুবন্ধনী নেই, কোন স্মৃতিচারণ নেই। শুধু আর একটানা শীতল নীরবতা। ভক্তরা এখন প্রশ্ন করছেন: ফিফার এই নীরবতা কি ইচ্ছাকৃত? ২০২৫ বিশ্ব ক্লাব কাপের প্রাক্কালে, মিশরীয় খেলোয়াড় হোসেন আস-শাহাত একটি "ফ্রি প্যালেস্টাইন" লেখা কব্জি-ব্যাজ পরে উপস্থিত হয়েছিল, কিন্তু  এ সংক্রান্ত ছবিগুলো দ্রুত মুছে ফেলা হয়েছিল।

এটি দুর্ঘটনাক্রমে ঘটেনি। গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ যখন তুঙ্গে  সেসময় যখন ফিফার সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার হিসাবে একজন মহিলা তার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ইস্রায়েলের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছিলেন তখন ফিফা কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। মনে হচ্ছে আলশাহাতের ব্রেসলেট অপসারণ উদাসীনতার কারণে ঘটেনি বরং তা এর নীতির অংশ।

মিথ্যা প্রচার অভিযান

মজার ব্যাপার হল, এই ব্যক্তি "হার গেম টু" আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা;  এটি একটি প্রচারাভিযান যা ফুটবলে সর্বজনীন বলে দাবি করে, কিন্তু যখন সমর্থকরা এ নিয়ে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে, এই কার্যক্রম  তাদের টুইটার ব্লক করে। দেখে মনে হচ্ছে নীরবতা কেবল ক্লাব এবং ফেডারেশনেই নয়, ন্যায়বিচারের দাবিদার প্রচারণার মধ্যেও রয়েছে।

কিন্তু আমরা সমর্থকরা নীরব নই। ক্লাব বিশ্বকাপে ফিলিস্তিনি পতাকা থেকে শুরু করে রেয়ো ভ্যালেকানো এবং সেভিলার মতো স্প্যানিশ স্টেডিয়াম পর্যন্ত, সাধারণ মানুষ দেখাচ্ছে প্রকৃত সংহতি কেমন। ফুটবল কর্মকর্তারা যত বেশি ফিলিস্তিনকে মুছে ফেলার চেষ্টা করবেন, তার উপস্থিতি তত বেশি প্রকট হবে।

এই সপ্তাহে, ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনি জাতীয় দলের প্রাক্তন গোলরক্ষক আবদুল্লাহ শুকফার স্ত্রীকে আল-মোয়াসিতে আক্রমণ চালিয়ে হত্যা করে যেখানে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে কোন সামরিক লক্ষ্যবস্তু ছিল না, ছিল কেবল গৃহহীনদের তাঁবু। তাকে হত্যা করা আকস্মিক ঘটনা ছিল না; এটি ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করার একটি পরিকল্পিত  ষড়যন্ত্রের অংশ এবং অন্য অনেকের মতো তার মৃত্যুকে বিশ্ব ফুটবল উপেক্ষা করবে।

অন্য দেশের কোনো খেলোয়াড়ের পরিবারের সঙ্গে এই ট্র্যাজেডি ঘটলে গোটা ক্রীড়াবিশ্বে তোলপাড় হতো। প্রোগ্রামগুলি বন্ধ হয়ে যেত, পন্ডিতরা তাদের শ্রদ্ধা জানাত এবং ক্লাবগুলি বিবৃতি দিত। একটি খেলা যে ন্যায়বিচার রক্ষার দাবি করে, তা এমন ট্র্যাজেডির মুখে নীরব থাকতে পারে না।

এগুলো ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়; ভবিষ্যতের ধ্বংস, সমাজের পতন এবং একটি জাতিকে মুছে ফেলা। যতক্ষণ না ফুটবল তার মতো জীবন রক্ষা করার সাহস খুঁজে পায়, ততক্ষণ এর সমস্ত নীতি  ও  মূল্যবোধ হবে নিরর্থক।

Tags

Your Comment

You are replying to: .
captcha